Translate

শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫

ধর্ম, বিজ্ঞান ও মুক্তমনা




                     ধর্ম, বিজ্ঞান ও মুক্তমনা

ধর্ম এবং বিজ্ঞানের ভেতরে সংঘাত এবং সামঞ্জস্য অনেকের কাছে বিতর্কের একটি প্রিয় বিষয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বিতর্ক এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করি। বর্তমানে মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, ধার্মিকতা, মৌলবাদ এবং বিজ্ঞানমনস্কতা ইত্যাদি নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে। এই বিতর্কে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কখনো কখনো অংশ নিতে হয়।

বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সরলীকরণ পছন্দ করি। আমার হাইপোথেসিস হচ্ছে, সত্য গোপনকারী এবং মিথ্যাবাদীদের বিশ্বাস করা চলে না। বিজ্ঞান এবং ধর্মের ভেতর সংঘাত আছে তবে এদেশের জাফরীয় তরিকার বিজ্ঞানমনস্করা যে মাত্রায় এবং যে প্রেক্ষিতে এই সংঘাতের বয়ান দেয় তা মিথ্যা এবং একই সাথে স্থুল দুরভিসন্ধিতে ঠাসা।
 এই মতলবাজি চলে তার কারন এদেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ এবং তরুন প্রজন্ম (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) যেকোনো ধরনের জানাশোনা থেকে বহুদূরে। প্রায় মূর্খরা এদের মতলবী বা অজ্ঞ বয়ান ভালমন্দ বিচার না করেই গিলতে থাকে।

 

ক্যাথলিক চার্চ এবং বিজ্ঞানের ভেতর সংঘাত ভালভাবে ডকুমেন্টেড। ধর্মে অবিশ্বাসী এবং বামধারার প্রগতিশীলদের কল্যাণে এই সংঘাত নিয়ে কিছু ভাসাভাসা ধারণা অনেকের আছে। প্রসঙ্গে যে নাম দুটো বারবার আসে তাঁরা হচ্ছেন গ্যালিলিও এবং ব্রুনো। চার্চের রোষানলে পরে গ্যালিলিওকে জীবনের শেষ অংশ গৃহবন্দী হয়ে কাটাতে হয়। সৌরজগৎ সম্পর্কে গ্যালিলিওর ধারনা তৎকালীন চার্চের ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় তাঁকে এই শাস্তি দেওয়া হয়। তবে মুক্তমনারা যেভাবে গ্যালিলিওর বন্দিদশা এবং তার ওপর চার্চ কর্তৃক দৈহিক নির্যাতনের বর্ণনা দেয় তা সত্য নয় বলেই মনে হয় (Watershed – Koestler ; Galileo goes to jail and other myths about science and religion – Ed. Numbers, Harvard University Press)এটি সত্য যে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়। ব্রুনোর প্রতি চার্চের যে অভিযোগগুলি ছিল তার সিংহভাগই খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব নিয়ে। বিজ্ঞানের ভুমিকা এখানে কম। কাজেই যারা সুযোগ পেলেই ব্রুনোকে বিজ্ঞানের কারনে ধর্মের হাতে শহীদবলে চালানোর চেষ্টা করে, তারা হয় জানে না, অথবা জেনেশুনে সত্য গোপনকারী।

ইসলামের সাথে বিজ্ঞানের দন্দ্বের ইতিহাস খুব সুস্পষ্ট নয়। তাই বলে মতলববাজরা বসে থাকবে কেন? এখানে ইবনে সিনাকে টেনে আনা হয়। মহা প্রতিভাবান, দোষে-গুনে মেশানো এই মানুষটি শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানীই ছিলেন না, ছিলেন দার্শনিক, কবি, গণিতবিদ, ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত, দশ বছর বয়স হতে কুরআনে হাফিজ। ইবনে সিনা জীবনের কোন পর্যায়েই ইসলামের মৌলিক আকিদাগুলিকে অস্বীকার করেন নি। মুতাযিলা বা ইমাম গাজ্জালীর দর্শন থেকে তাঁর চিন্তাধারার পার্থক্য একটি স্বাভাবিক ঘটনা। শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদরা সবাই একইভাবে ভাবেন না। ইবনে সিনাকে নিয়ে টানাটানি প্রমান করে বাঙ্গালী বিজ্ঞানমনস্ক এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীরা কতবড় ঠগ।

গ্যালিলিও, ব্রুনো, ইবনে সিনা, শত শত বছর আগের কথা। বিংশ শতাব্দীর দিকে তাকানো যাক। সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী বামধারার প্রগতিশীলরা। মার্কসবাদ আর বস্তুবাদের কষ্টিপাথরে এরা সত্যমিথ্যা যাচাই করে। মানবিকতা ধরে রাখতে পারে না বলে উথলে ওঠে। সম্ভবত রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারনে, বিজ্ঞানের ওপর নিষ্ঠুরতম আক্রমন কিন্তু এই প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্কদের দিয়েই হয়েছে।

লান্ডাউ (Landau), রুমার (Rumer), কাপিতযা (Kapitza), সুবনিকভ (Shubnikov), শাখারভ (Shakarov), লিস্ট বড় হতেই থাকবে। শ্রেষ্ঠ সব রাশান পদার্থবিদ। এরা প্রত্যেকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বা প্রগতিশীলতা নামক আকিদারবলি। কেউ সাইবেরিয়ার বন্দী শিবিরে, কপাল ভালো হলে গৃহবন্দী, কাউকে স্রেফ গুলি করে মারা হয়েছে। এদের দোষ অনেক ক্ষেত্রেই এই যে, এদের বিজ্ঞান মার্কস-এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিকধ্যানধারণার সাথে মেলে নি। অন্যান্যদের শাস্তি পেতে হয়েছে রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারনে। তরুন সুবনিকভকে হত্যা করা হয় তাঁর আরো অনেক সহকর্মীর সাথে। শ্রেষ্ঠতম (আমার বিবেচনায়) রাশান বিজ্ঞানী লান্ডাউ দৈহিক নির্যাতনের মুখে অপরাধস্বীকার করতে বাধ্য হন। যদিও শত শত বছর আগের মৌলবাদী ক্যাথলিকরাও গ্যালিলিওকে দৈহিক নির্যাতন করেছে এমন প্রমান পাওয়া দুষ্কর।
 
এদেশের বিজ্ঞানমনস্করা যখন ধর্ম আর বিজ্ঞানের সংঘাত নিয়ে বুলি কপচায়, তখন মনে হয় প্রশ্ন করি সুবনিকভের নাম জানা আছে? জীবনে কি সুবনিকভ ডি হাস (de Haas) এফেক্টের নাম শুনেছেন? জানি শুধুই এতে সময় নষ্ট হবে। অপগন্ডগুলি এসব শব্দই শোনেনি তাদের এই জীবনে। ভন্ডরা করে খাচ্ছে অন্যদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে।

লিখেছেন ড. সালেহ হাসান নকিব
ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি ওয়েলিংটন, নিউজিল্যান্ড
সাবেক অধ্যাপক রাজশাহী ইউনিভার্সিটি, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন